
জুলাই আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন আবু বাকের মজুমদার। সম্প্রতি জুলাই আন্দোলনের আদর্শ ধারণ করে আন্দোলনে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের নিয়ে নতুন ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। নবগঠিত ছাত্রসংগঠন, ছাত্ররাজনীতির নানা দিক এবং সাম্প্রতিক নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তিনি কথা বলেছেন দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন আবির হাকিম
দৈনিক ইত্তেফাক: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি মিলে রাজনৈতিক দল গঠন করছে। একই সময়ে আপনিও ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন। এ রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন কি ভ্রাতৃপ্রতিম বা সহযোগী সংগঠন হতে যাচ্ছে?
আবু বাকের মজুমদার: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি মিলে একটা রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া চলমান আছে, আমরা এই প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানাই। আমরা শিক্ষার্থীরা, যারা জুলাই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছি, ছাত্রদের সেই শক্তিকে সংগঠিত করে একটা ছাত্রসংগঠন গড়ে তোলার কাজ করছি। এটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া এবং স্বতন্ত্র ছাত্রসংগঠন হিসেবে আমরা আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছি। এই ছাত্রসংগঠন কোনো রাজনৈতিক দলের ভ্রাতৃপ্রতিম বা সহযোগী সংগঠন নয়। তবে দুইটা সংগঠনই যেহেতু জুলাই অভ্যুত্থানের আদর্শকে ধারণ করে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, সেক্ষেত্রে আমাদের একটা আদর্শিক মিল থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
ইত্তেফাক: আপনারা দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথা বলেছেন, দলীয় ছাত্ররাজনীতি থাকলে সমস্যাটা কোথায়? আপনার মতে ছাত্ররাজনীতির পরিসর কেমন হতে পারে?
আবু বাকের: আমরা যে লেজুড়বৃত্তি বন্ধের কথা বলেছি, তা মূলত শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠনের অন্তরায় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনৈতিক অন্ধত্ব তৈরি করছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সরাসরি হস্তক্ষেপে ছাত্রসংগঠনের কমিটি হচ্ছে। আমরা দেখেছি, অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদেরা এবং রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ সময় চেষ্টা করেও ফ্যাসিবাদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারেনি। যদিও অভ্যুত্থানে সব দলের নেতাকর্মীরাই রাজপথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে, তবে বাস্তবতা হচ্ছে এতে নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। এই বাস্তবতা মেনে সামনের দিনগুলোতে ছাত্রদের বা ছাত্রসংগঠনগুলোর ওপর রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তি চাপিয়ে দেওয়ার কোনো অধিকার নেই। আমি মনে করি বাংলাদেশের আগামী দিনের নতুন রাজনীতি নির্মাণ করবে ছাত্ররা, সে রাজনীতি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোকে কাজ করতে হবে।
ইত্তেফাক: ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবিতে আপনাদের কর্মসূচি ছিল। এই দাবির দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছেন?
আবু বাকের: আগস্টের পর থেকেই আমরা ডাকসু এবং সব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছি। দাবির প্রেক্ষিতে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগও নিয়েছে। এখন আমাদের নতুন ছাত্রসংগঠন দ্রুত সময়ের মধ্যেই ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচনের জন্য দাবি তুলব এবং প্রয়োজনে আন্দোলন গড়ে তুলব। আশা করছি দ্রুত ডাকসু নির্বাচন আদায় করতে পারব।
ইত্তেফাক: ক্যাম্পাসের ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলো ডাকসু সংস্কারে অনেকগুলো প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাস্তবায়ন করা সময়সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে এখনই ডাকসু নির্বাচন কতটা সম্ভব বলে মনে করছেন?
আবু বাকের: আমরাও প্রস্তাব দিয়েছি। কিন্তু আমরা মনে করছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি আন্তরিক হয়, তাহলে যে সংস্কারগুলো একেবারেই আবশ্যক, সেগুলো করেই ডাকসু নির্বাচন করতে পারে এবং পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট নিয়ে যারা নেতৃত্বে আসবে, তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে ডাকসুর সামগ্রিক সংস্কার করতে পারবে।
ইত্তেফাক: আপনারা নতুন যে দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন, তার সাংগঠনিক কাঠামো এবং কর্মসূচি কেমন হবে?
আবু বাকের: আমরা যে নতুন ছাত্রসংগঠন নিয়ে আসছি, তাতে প্রাথমিকভাবে আমরা আহ্বায়ক কমিটি গঠন করতে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পদের ক্রম হবে আহ্বায়ক, সদস্যসচিব, মুখপাত্র এবং সংগঠক। এক্ষেত্রে আহ্বায়কের সঙ্গে যুগ্ম আহ্বায়ক প্যানেল এবং সদস্যসচিবের সঙ্গে যুগ্ম সদস্যসচিব প্যানেল থাকবে। আমাদের কর্মসূচির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় এবং শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করার মতো বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে। আমরা ‘স্টুডেন্ট ফার্স্ট’ এবং ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ স্লোগানকে সামনে রেখে আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করব। শিক্ষার্থীদের যেসব যৌক্তিক দাবি থাকবে, আমরা তা আদায় করতে তাদের সঙ্গে নিয়ে কর্মসূচি পরিচালনা করব। এছাড়া রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার এবং ছাত্র নাগরিক সংহতির মতো বিষয়গুলো আমাদের কর্মসূচিতে প্রাধান্য পাবে।
ইত্তেফাক: জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা দেশের সব ছাত্রসংগঠনের মধ্যে একটা ঐক্য গড়ে উঠতে দেখেছি। কিন্তু এরপর নানা কারণে সে ঐক্যে ফাটল ধরেছে। এই ঐক্য কেন নষ্ট হলো?
আবু বাকের: দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের কারণে জুলাই আন্দোলনের সময় এ দেশের ছাত্র-জনতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে উঠেছিল। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পতনের পর এখন সব রাজনৈতিক দলই নিজেদের পরিসরে নিজস্ব দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে, এটাই প্র্যাকটিক্যাল। আমরা আহ্বান করি, বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রদল বা শিবিরের মতো সংগঠনগুলো যেভাবে সংঘাতে জড়াচ্ছে, তারা যেন শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাসের স্বার্থে সংঘাত থেকে সরে আসে।
ইত্তেফাক: বর্তমান সরকার রাষ্ট্র সংস্কার ও নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নির্মাণে কাজ করছে। ছাত্রনেতা হিসেবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
আবু বাকের: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে সংস্কারের লক্ষ্যে কাজ করছে, তাতে আমরা শিক্ষার্থীরা সরকারের পাশে আছি। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি চর্চার কারণে সংস্কারের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। আমরা সরকারকে বলতে চাই, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরো বেশি আলোচনার ভিত্তিতে যেন সংস্কার প্রস্তাবগুলো করা হয়, এতে আমরা আরো ফলপ্রসূ সমাধান পাব। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান থাকবে, রাজনৈতিক সততার জায়গা থেকে তারা যেন জুলাই আন্দোলন-পরবর্তী মানুষের প্রত্যাশাকে আরো বেশি ধারণ করে।